কেবল নম্বরেই কি মেধা মাপা যায়?
” ৯৮ পেয়েছি!” — এই বাক্যটা যেন এক গর্বের উৎস, আত্মীয়স্বজনের মুখে হাসি, আর সামাজিক মিডিয়ায় পোস্ট করার মতো ট্রফি । কিন্তু, একটা প্রশ্ন — এই নম্বর কি একজন শিক্ষার্থীর আসল দক্ষতার পরিমাপক?
বর্তমান ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় এক বিষয়ে নজর না দিলেই নয়, তা হলো ** সফট স্কিলস ** বা ** নরম দক্ষতা ** । এ এমন এক ধরনের যোগ্যতা, যা শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন মানুষকে করে তোলে সফল, সহানুভূতিশীল ও কার্যকর ।
সফট স্কিলস কী? 🤔
সফট স্কিলস বলতে বোঝানো হয় সেই সব দক্ষতা যা মৌলিক মানবিক যোগাযোগ, আচরণ ও মানসিক গঠনকে প্রতিনিধিত্ব করে । এর মধ্যে পড়ে
- ** যোগাযোগ দক্ষতা( Communication skills) **
- ** দলগত কাজের ক্ষমতা( cooperation) **
- ** সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা( Problem solving ability) **
- ** সময় ব্যবস্থাপনা( Time Management) *
- ** নেতৃত্ব( Leadership) **
- ** আত্মবিশ্বাস( Self Confidence) **
- ** মানবিক মূল্যবোধ( Empathy & Ethics) ** এই দক্ষতাগুলি অনেক সময় আমাদের পাঠ্যক্রমের বাইরে রয়ে যায়, অথচ এগুলোই আমাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের স্তম্ভ ।
ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলিত ধারা 📚
ভারতে শিক্ষার মূল কাঠামো বহুদিন ধরেই ছিল পাঠ্যবই- কেন্দ্রিক ও পরীক্ষাভিত্তিক । নম্বর, গ্রেড, এবং পরীক্ষার ফলাফলই যেন ছাত্রছাত্রীদের মেধা যাচাইয়ের একমাত্র মাপকাঠি । এতে তিনটি বড় সমস্যা দেখা যায়
- ** সৃজনশীলতার অভাব ** শিক্ষার্থীরা মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী হলেও নতুন কিছু ভাবতে পারে না ।
- ** আত্মবিশ্বাসের অভাব ** পরীক্ষায় নম্বর কম হলে নিজেকে অযোগ্য ভাবতে শেখে ।
- ** আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক গড়ার অক্ষমতা ** দলগত কাজ, বিতর্ক, শ্রবণশক্তি — সবকিছু উপেক্ষিত ।
কর্মক্ষেত্রে সফট স্কিলস- এর চাহিদা 💼
বর্তমান চাকরির বাজারে শুধু ডিগ্রি বা কারিগরি জ্ঞান যথেষ্ট নয় । বহু সংস্থা আজ ** সফট স্কিলস **- কে রাখছে তাদের নিয়োগ নীতির প্রথম সারিতে । নিচে কিছু চিত্র দেওয়া হলো
- NASSCOM- এর রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি ১০ জন কর্মীর মধ্যে ৭ জনই কর্মক্ষেত্রে সফট স্কিলসের কারণে টিকে থাকতে পারেন না ।
- WEF( World Economic Forum) ২০২5 সালের” Top 10 Chops” এর মধ্যে অন্তত ৬টি সফট স্কিলস ভিত্তিক ।
- বহু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি যেমন Google, Infosys, TCS ইত্যাদি নিয়োগে **Communication, Collaboration, Creativity & Critical Allowing **- এর উপর জোর দিচ্ছে ।
শিক্ষাব্যবস্থায় সফট স্কিলস অন্তর্ভুক্তির জরুরি প্রয়োজন 🔁
১. ** বাচ্চাদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ দিতে হবে **
স্কুলে যদি বিতর্ক, নাটক, কবিতা পাঠ, গ্রুপ ডিসকাশন এর মতো কর্মকাণ্ড আরও বেশি হয়, তাহলে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে ।
২. ** পরীক্ষা- ভিত্তিক নয়, দক্ষতা- ভিত্তিক মূল্যায়ন **
শুধু লিখিত পরীক্ষার নম্বর নয়, শিক্ষার্থীর ** নৈতিক মূল্যবোধ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও সহনশীলতা **- র মূল্যায়নও জরুরি ।
৩. ** শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও মানসিকতা পরিবর্তন **
শুধু ছাত্র নয়, শিক্ষককেও হতে হবে সফট স্কিলস- এর রোল মডেল । এজন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণে মানবিক যোগাযোগ, শ্রবণ ক্ষমতা, এবং দল পরিচালনার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ।
৪. ** NEP 2020- এর সুফল গ্রহণ **
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ সফট স্কিলসের প্রয়োজনীয়তা বুঝেছে । সেখানে বলা হয়েছে ** 21st Century Chops ** শেখানোর কথা, যা সফট স্কিলস অন্তর্ভুক্ত করে ।
বাস্তব উদাহরণ 🎯
✅ উদাহরণ ১” অঙ্কে ১০০, কিন্তু ইন্টারভিউতে ব্যর্থ”
একজন শিক্ষার্থী প্রতিটি পরীক্ষায় ৯৫ পায়, কিন্তু চাকরির ইন্টারভিউতে মুখ ফুটে কথা বলতেই পারে না । কারণ? আত্মবিশ্বাস ও কমিউনিকেশন স্কিলসের অভাব ।
✅ উদাহরণ ২” পড়াশোনায় মাঝারি, কিন্তু সংস্থার সিইও!”
আরেকজন ছাত্র হয়তো সবসময় ৬০- ৭০ পেয়েছে, কিন্তু তার সমস্যা সমাধানের কৌশল, নেতৃত্ব, ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এমন ছিল যে সে নিজের স্টার্টআপ খুলে ফেলেছে ।
প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু হোক সফট স্কিলস শিক্ষা 🧒
সফট স্কিলস শিক্ষার বীজ বপন করতে হবে ** প্রাক- প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরেই ** । যেমন
- গল্প বলা ও শ্রবণ চর্চা
- একসাথে খেলা ও দলগত দায়িত্ব
- ছোট ছোট ক্লাস প্রেজেন্টেশন
- সহানুভূতি শেখাতে রোল- প্লে
প্রযুক্তির যুগে সফট স্কিলস আরও প্রাসঙ্গিক 📱
এখন AI, অটোমেশন, চ্যাটবট — সবই আমাদের কাজ সহজ করছে । কিন্তু যেটা কোনও মেশিন দিতে পারে না, তা হলো ** মানবিক অনুভব ও যুক্তিনির্ভর সম্পর্ক ** । তাই সফট স্কিলস মানেই এখন ** unborn- evidence Skill ** ।
অভিভাবকদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ 👨👩👧
শুধু স্কুল বা সরকার নয়, ** অভিভাবকদের **- ও মানসিকতা বদলাতে হবে ।” নম্বর কতো পেলি?” — এই প্রশ্নের বদলে হতে পারে
*” কোনো নতুন বন্ধু করেছো?”
*” তুমি আজ কী শিখলে যেটা আগে জানতা না?”
*” তোমার বন্ধু সমস্যায় পড়লে তুমি কী করেছিলে?”
সময় এসেছে সফট স্কিলসকে কেন্দ্রে আনার 🕰️
ভারত এখন বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিচ্ছে — চাঁদের মাটিতে অভিযান, স্টার্টআপ রেভল্যুশন, প্রযুক্তি রপ্তানিতে সাফল্য । কিন্তু এসবের পেছনে থাকা মানুষদের সাফল্যের গল্পে ** নম্বর নয়, সফট স্কিলস **- ই ছিল চালিকাশক্তি ।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি সত্যিই আগামী প্রজন্মকে” সম্পূর্ণ মানুষ” হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, তবে সফট স্কিলস শিক্ষা আর বিলাসিতা নয়, বরং এক অপরিহার্যতা ।
✍️ শেষ কথা
জীবন এক পরীক্ষা — যেখানে প্রশ্নপত্রে নম্বর নেই, কিন্তু ** সহানুভূতি, যোগাযোগ আর আত্মবিশ্বাস ** থাকলেই সাফল্য নিশ্চিত । ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সফট স্কিলসের অন্তর্ভুক্তি সেই জীবনের জন্যই প্রস্তুতি।
banglablogs.in ©️ 2025
All rights reserved