ভূমিকা
“রথের চাকা গড়ায় প্রাণের টানে” — এই প্রবাদ বাক্যই যেন বাংলার রথযাত্রাকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে প্রকাশ করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রথযাত্রা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে বাংলার সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ। পুরী রথযাত্রার ছায়ায় গড়ে উঠলেও বাংলার রথযাত্রা ধীরে ধীরে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় তৈরি করেছে। এই লেখায় আমরা বাংলার রথযাত্রার ঐতিহাসিক পটভূমি, বিবর্তন, স্থানীয় বৈশিষ্ট্য এবং তার সাংস্কৃতিক প্রভাব বিশদভাবে আলোচনা করব।
রথযাত্রার উৎস ও পুরাণকথা
রথযাত্রার সূচনা কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও পুরাণ মতে এর মূল কেন্দ্র ওড়িশার পুরী। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তিকে তিনটি আলাদা রথে করে মন্দির থেকে গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার এই প্রথা চলে আসছে সহস্র বছর ধরে। পুরাণ মতে, জগন্নাথ হলেন বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণ। তার দিদি সুভদ্রা এবং ভাই বলরাম — এই তিনজনকে কেন্দ্র করে এই রথযাত্রার আয়োজন।
বাংলার বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, যেমন স্কন্দ পুরাণ, ব্রহ্ম পুরাণ, ও পদ্ম পুরাণ-এ রথযাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষ করে চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় থেকেই রথযাত্রা আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বাংলায় রথযাত্রার আগমন
বাংলায় রথযাত্রার আগমন প্রায় ৫০০ বছর আগে, বিশেষত চৈতন্য মহাপ্রভুর যুগে। চৈতন্যদেব, যিনি কৃষ্ণভাবনায় বিশ্বাসী ছিলেন, তিনি পুরী রথযাত্রাকে বাংলায় আনার পথ প্রশস্ত করেন। নবদ্বীপ, শ্রীখণ্ড, শান্তিপুর, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, কলকাতা সহ বহু স্থানে রথযাত্রার প্রচলন শুরু হয় এই সময় থেকেই।
চৈতন্যদেব নিজে পুরীতে রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করতেন এবং তাঁর ভক্তরা বাংলার বিভিন্ন জায়গায় এই উৎসবের আয়োজন করতেন। ফলে রথযাত্রা শুধু ধর্মীয় নয়, ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যম হয়ে ওঠে।
বাংলার রথযাত্রার বৈশিষ্ট্য
বাংলার রথযাত্রার সঙ্গে পুরীর রথযাত্রার মিল থাকলেও কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়:
১. স্থানীয় দেবতা ও রথ
বাংলায় অনেক জায়গায় জগন্নাথের পাশাপাশি স্থানীয় দেবতাকেও রথে স্থান দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও রাধা-কৃষ্ণ, আবার কোথাও রুক্মিণী বা গৌর-নিত্যানন্দের প্রতিমা রথে উঠানো হয়।
২. কাঠের রথ নির্মাণ
প্রতি বছর নতুন করে রথ নির্মাণের রীতি এখন অনেক জায়গায় বিলুপ্ত, তবে এখনও কিছু গ্রামে পুরোনো কাঠের রথেই চলছে পরম্পরা। বাঁশ, কড়ই কাঠ, শাল কাঠ দিয়ে তৈরি এই রথ প্রাচীন শিল্পকলার এক নিদর্শন।
৩. মেলা ও উৎসব
রথযাত্রা বাংলায় কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং তা এক বিশাল মেলায় পরিণত হয়। রথকে ঘিরে বসে পুতুল, মিষ্টি, খেলনা, বাদ্যযন্ত্র, বাঁশির দোকান। যাত্রাপালা, কবিগান, কীর্তনের আসর বসে বহু জায়গায়।
ইতিহাসের আলোকে উল্লেখযোগ্য কিছু রথযাত্রা
১. মাহেশের রথ (হুগলি)
বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন ও বিখ্যাত রথযাত্রা হল মাহেশের রথ। ইতিহাস অনুযায়ী, এই রথযাত্রার সূচনা হয় ১৩৯৭ খ্রিষ্টাব্দে। কথিত আছে, এক বাঙালি ব্যবসায়ী পুরী থেকে এনে এই উৎসব শুরু করেন। বর্তমানে মাহেশের কাঠের রথ প্রায় ৫০ ফুট উঁচু এবং আট চাকার। লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয় এই উৎসবে।
২. গুপ্তিপাড়ার রথ (হুগলি)
এখানকার রথ ১৭৫০-এর দশকে নির্মিত। বিশেষত গুপ্তিপাড়ার ভাণ্ডানী গান ও কীর্তনের জন্য রথযাত্রা বিখ্যাত। শোনা যায়, এখানকার রথ ৩২ চাকার, যা বাংলার বৃহত্তম রথগুলির একটি।
৩. সুতাহাটার রথ (পূর্ব মেদিনীপুর)
এই অঞ্চলের রথযাত্রা গ্রামের লোকসংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এখানে রথের সঙ্গে হাড়িয়ার খেলা, কীর্তন ও নাট্যাভিনয় চলতে থাকে এক সপ্তাহ ধরে।
ব্রিটিশ আমলে রথযাত্রা
ব্রিটিশ শাসনের সময়েও রথযাত্রা চালু ছিল এবং অনেক ক্ষেত্রেই এই উৎসব ইংরেজ শাসকদের কৌতূহল উদ্রেক করেছিল। বহু ইংরেজ পর্যটক বাংলার রথযাত্রার বিবরণ দিয়েছেন তাঁদের ভ্রমণকাহিনিতে। অনেকে মেলা ও রথের ছবি তুলেছিলেন বা স্কেচ এঁকেছিলেন। এই সময়েই অনেক জায়গায় স্থায়ী রথঘর নির্মিত হয়।
রথযাত্রা ও বাংলার লোকসংস্কৃতি
রথযাত্রা বাংলার লোকসংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বিশেষ করে বাউল, কীর্তন, গম্ভীরা, চৌদ্দভূত, পাঁচালি গান ইত্যাদি এই সময়ে বিশেষভাবে পরিবেশিত হয়। বহু লোককথা ও ধর্মীয় নাটক এই উৎসবের অংশ হয়ে উঠেছে।
রথের গান:
“এগো রথ, পিছাও রথ,
জগন্নাথ আসছে পথে।”
এই ধরনের গান শুধু আনন্দের উৎস নয়, বরং লোকজ বিশ্বাস, আশা ও ভক্তির প্রকাশ।
আধুনিক যুগে রথযাত্রার রূপান্তর
বর্তমানে শহরাঞ্চলে রথযাত্রা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। মন্দিরভিত্তিক অনুষ্ঠান, টিভি সম্প্রচার, ডিজিটাল লাইটিং, সাউন্ড সিস্টেম যুক্ত হয়েছে রথযাত্রায়। তবে গ্রামীণ বাংলায় এখনও ঐতিহ্য বজায় রেখে রথযাত্রা পালিত হয়।
বিশেষত শিশুদের কাছে এটি এক বিশাল আনন্দের দিন। রথের মেলা মানেই নতুন খেলনা, হাওয়াই মিঠাই, বাঁশি, ঘুড়ি ও পুতুলের আনন্দ।
রথযাত্রা ও সমাজচেতনা
রথযাত্রা কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি সামাজিক সম্প্রীতির এক প্রতীক। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ এই মেলায় অংশ নেন। এতে একধরনের সামাজিক মেলবন্ধনের সৃষ্টি হয়।
এছাড়াও বহু জায়গায় রথযাত্রা উপলক্ষে রক্তদান শিবির, বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবির, পাঠাগার উদ্বোধন, পরিবেশ সচেতনতা ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
উপসংহার
রথযাত্রা আজ আর শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জনমানসের সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। শত শত বছর ধরে এই উৎসব বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে উৎসাহ ও ভক্তির সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
এই রথযাত্রা আমাদের শিক্ষা দেয় সমবেত হওয়ার, আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার এবং ঐতিহ্যকে গর্বের সঙ্গে বহন করার। প্রতিটি চাকার ঘূর্ণনের সঙ্গে ঘুরে চলে বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মানুষের আবেগ।
আপনার এলাকায় রথযাত্রার কেমন আয়োজন হয়? আমাদের জানাতে পারেন নিচের কমেন্ট বক্সে। শুভ রথযাত্রা!
banglablogs.in ©️ 2025
All rights reserved