স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী

Spread the love

স্বামী বিবেকানন্দ ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক গুরু, দার্শনিক ও সমাজসংস্কারক। তাঁর জীবন ও কর্মের প্রভাব আজও ভারত ও বিশ্বব্যাপী অমলিন। তিনি শুধু আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে নয়, সমাজ ও দেশের প্রতি তাঁর অবদানও অসামান্য। তাঁর চিন্তা-ধারা এবং শিক্ষা আজও আমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

শৈশবকাল

স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতায়, কাঁচড়াপাড়ার একটি সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর জন্মনাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন একজন আইনজীবী এবং মাতা ভবতারিণী দেবী ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও গুণী নারী। ছোটবেলা থেকেই নরেন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং প্রশ্নকারী। তিনি যেকোনো কিছু শিখতে বা বুঝতে ইচ্ছুক ছিলেন। তাঁর শৈশবকাল থেকেই আধ্যাত্মিকতা এবং ধর্মীয় ভাবনা তাঁর মনের গভীরে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল।

শিক্ষা জীবন

নরেন্দ্রনাথ কলকাতার খ্যাতনামা স্কুল এবং পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। স্কুলে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁকে প্রায়ই শিক্ষকরা অত্যন্ত মেধাবী ও একাধিক বিষয়ে আগ্রহী ছাত্র হিসেবে প্রশংসা করতেন। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য এবং বিজ্ঞান। ছোটবেলায় তিনি হিন্দু ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ ‘ভগবদ গীতা’ এবং ‘উপনিষদ’ নিয়ে গভীর আগ্রহী ছিলেন। এসব গ্রন্থে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং মানবজীবনের উদ্দেশ্য খোঁজার চেষ্টা করতেন।

কলেজের পড়াশোনা শেষ করার পর, নরেন্দ্রনাথ বিভিন্ন দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তাঁর মধ্যে বিশেষভাবে দার্শনিক ঈশ্বরপ্রেম এবং মানুষের চেতনা সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে পরিচয়

স্বামী বিবেকানন্দের জীবন পাল্টে দেয় যে ঘটনা, তা হল রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ। একদিন তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসকে প্রশ্ন করেছিলেন, “ঈশ্বরকে আমি কীভাবে দেখতে পারি?” রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন, “ঈশ্বরকে দেখা যায় না, তবে তাঁকে অনুভব করা যায়।” এই কথাটি নরেন্দ্রনাথের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তাঁর জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য হয়ে নরেন্দ্রনাথ ‘ভক্তি’, ‘জ্ঞানি’ ও ‘দর্শন’ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। তিনি রামকৃষ্ণের শিষ্য হিসেবে একাগ্রতার সঙ্গে আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁকে ‘বিবেকানন্দ’ নাম দেন, অর্থাৎ ‘বুদ্ধিমানের আনন্দ’। এটি তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

তীর্থযাত্রা এবং ভ্রমণ

রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যত্ব গ্রহণের পর, স্বামী বিবেকানন্দ একাধিক বার ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে তীর্থযাত্রা করেন। তিনি দেশব্যাপী ভ্রমণ করে মানুষের জীবনযাত্রা, সমাজের অবস্থা এবং ভারতীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক দেখে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হন। তিনি অনুভব করেন যে, ভারতীয় সমাজে অনেক সামাজিক অবক্ষয় এবং অন্ধবিশ্বাস প্রবলভাবে বিদ্যমান। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য, তিনি ভারতীয় জনগণের মধ্যে শিক্ষার প্রসার, ধর্মীয় পুনর্জাগরণ এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করতে শুরু করেন।

১৮৯৩ সালের শিকাগো ধর্মমহাসভা

১৮৯৩ সালে শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই মহাসভায় তাঁর বক্তৃতা ভারতীয় সংস্কৃতি ও হিন্দু ধর্মের উপর আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁর বক্তৃতা ছিল প্রভাবশালী, শক্তিশালী এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ। তিনি প্রথমবারের মতো হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য এবং মানবতার ঐক্যের কথা পৃথিবীকে জানান। তিনি বলেন, “আপনারা সব ধর্মকেই সম্মান করুন, কারণ সব ধর্মের ভিতরে সত্যের একটি নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে।”

স্বামী বিবেকানন্দের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা পৃথিবীজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তিনি বিশ্বের এক মহান আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁর বক্তৃতায় যে আত্মবিশ্বাস, শক্তি ও বোধ ছিল তা আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।

সমাজসেবায় অবদান

স্বামী বিবেকানন্দ শুধু আধ্যাত্মিক দিকেই নয়, সমাজসেবার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি জানতেন যে, মানব জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য শুধু আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন নয়, বরং মানুষের সেবাই আসল ধর্ম। তিনি বলেন, “যতদিন মানুষ অনাহারে, পীড়িত এবং অসুস্থ থাকবে, ততদিন ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে না।”

স্বামী বিবেকানন্দ এ ধারণা থেকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্কুল এবং আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভারতের সাধারণ জনগণের মধ্যে জ্ঞান, শিক্ষা এবং ধর্মীয় সচেতনতা প্রসারে কাজ করেন। তাঁর শিক্ষা ছিল, “যতদিন মানুষ উপবাস থাকবে, ততদিন তুমি আধ্যাত্মিকতার কথা বলো না। আগে তার পেট ভরাও।”

শেষ দিন

স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০২ সালের ৩১ জুলাই কলকাতার বেলুর মঠে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেন। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তবে তাঁর জীবন ও কর্মের প্রভাব এত ব্যাপক ছিল যে, আজও তিনি ভারতের সর্বজনীন আধ্যাত্মিক ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক। তাঁর আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের মনকে আলোকিত করে যাবে।

স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন

স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন ছিল মানবতার সেবায় নিবেদিত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ নিজের শক্তি, আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে নিজের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে, মানবজীবনের উদ্দেশ্য একমাত্র ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা অর্জন নয়, বরং সমাজের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণে কাজ করা।

তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ছিল:

  1. নিজেকে জানো: স্বামী বিবেকানন্দের মতে, আত্মজ্ঞানই জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।
  2. শক্তির সঞ্চয়: তিনি মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এবং শক্তির জন্ম দিয়েছিলেন।
  3. সমাজসেবা: মানবকল্যাণ, বিশেষত দরিদ্রদের জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

উপসংহার

স্বামী বিবেকানন্দের জীবন এক শাশ্বত অনুপ্রেরণা। তাঁর শিক্ষা ও দর্শন আজও আমাদের জীবনে দিকনির্দেশনা দেয়। তিনি সমাজ, ধর্ম, এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা আমাদের বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক। তাঁর কর্ম এবং চিন্তা ভারতীয় সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, এবং তিনি আজও কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন। তাঁর জীবন ও আদর্শ আমাদের শিখিয়ে যায় যে, শুধুমাত্র আত্মচিন্তা ও আধ্যাত্মিকতা নয়, বরং সমাজের কল্যাণেও আমাদের কাজ করতে হবে।

banglablogs.in ©️ 2025
All rights reserved

Leave a comment