মেঘের রাজ্য মেঘালয়

Spread the love

মেঘালয়, নামের অর্থই “মেঘের বাসস্থান”। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্য তার মনোরম পাহাড়, ঝর্ণা, গুহা, এবং আদিবাসী সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। শিলং-এর কোলাহলপূর্ণ শহর থেকে শুরু করে মাওলিনং-এর পরিচ্ছন্ন গ্রাম, চেরাপুঞ্জির রোমাঞ্চকর ঝর্ণা থেকে শুরু করে দাউকি নদীর স্বচ্ছ জল— মেঘালয় প্রকৃতিপ্রেমী ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য আদর্শ গন্তব্য।

এই ভ্রমণ গাইডে মেঘালয়ের প্রধান পর্যটনস্থল, যাতায়াত ব্যবস্থা, আবহাওয়া, বাজেট পরিকল্পনা এবং ভ্রমণের সেরা সময় সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হলো।


কীভাবে পৌঁছাবেন?

বিমানপথ

মেঘালয়ের একমাত্র বিমানবন্দরটি শিলং-এর উমরই (Umroi) বিমানবন্দর। কলকাতা, গুয়াহাটি, এবং অন্যান্য কয়েকটি শহর থেকে এখানে সরাসরি ফ্লাইট পাওয়া যায়। তবে, বেশিরভাগ পর্যটকই গুয়াহাটি বিমানবন্দর পর্যন্ত উড়ে এসে সড়কপথে শিলং যান (প্রায় ৩ ঘণ্টার পথ)।

রেলপথ

মেঘালয়ে কোনো রেলস্টেশন নেই। সবচেয়ে কাছের বড় রেলস্টেশন গুয়াহাটি (Assam)। গুয়াহাটি থেকে শিলং যেতে প্রাইভেট ট্যাক্সি বা শেয়ার করা ট্যাক্সি পাওয়া যায়।

সড়কপথ

গুয়াহাটি থেকে শিলং বা চেরাপুঞ্জি যাওয়ার জন্য NH-6 হাইওয়ে খুব ভালো। সড়কপথ বেশ চমৎকার, এবং পুরো যাত্রায় পাহাড় ও সবুজের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায়।


ঘুরতে যাওয়ার সেরা সময়

মেঘালয় এমন এক রাজ্য যেখানে সারাবছরই ভ্রমণের জন্য অনুকূল আবহাওয়া থাকে। তবে, পর্যটকদের জন্য দুটি প্রধান ঋতু আদর্শ—

  1. অক্টোবর থেকে এপ্রিল (শীতকাল ও বসন্ত):
    • আবহাওয়া শুষ্ক ও মনোরম থাকে।
    • ঝর্ণাগুলোর জল কমে যায়, কিন্তু গুহাগুলি অ্যাডভেঞ্চারের জন্য আদর্শ।
    • চেরাপুঞ্জি, দাউকি নদী, এবং মাওলিনং ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত সময়।
  2. জুন থেকে সেপ্টেম্বর (বর্ষাকাল):
    • চেরাপুঞ্জি ও মাওসিনরাম পৃথিবীর অন্যতম বৃষ্টিবহুল স্থান, ফলে প্রকৃতি আরও সুন্দর হয়ে ওঠে।
    • ঝর্ণাগুলি পূর্ণমাত্রায় জলপ্রবাহে থাকে, যা দেখার জন্য অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

প্রধান পর্যটনস্থান

১. শিলং – মেঘালয়ের রাজধানী

শিলং শুধুমাত্র মেঘালয়ের রাজধানী নয়, এটি “স্কটল্যান্ড অফ দ্য ইস্ট” নামেও পরিচিত।

দর্শনীয় স্থান:

  • শিলং পিক: শিলং শহরের সবচেয়ে উঁচু স্থান, এখান থেকে পুরো শহরের অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়।
  • এলিফ্যান্ট ফলস: তিন স্তরে বিভক্ত এক অনিন্দ্যসুন্দর জলপ্রপাত।
  • উমিয়াম লেক: মেঘালয়ের অন্যতম জনপ্রিয় হ্রদ, যেখানে নৌকা ভ্রমণ ও কায়াকিং করা যায়।
  • ওয়ার্ডস লেক: শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, হাঁটার জন্য মনোরম জায়গা।
  • ডন বসকো মিউজিয়াম: উত্তর-পূর্ব ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বোঝার জন্য আদর্শ স্থান।

২. চেরাপুঞ্জি – পৃথিবীর অন্যতম বর্ষাবহুল স্থান

চেরাপুঞ্জি (সোহরা) তার প্রচুর বৃষ্টি ও জলপ্রপাতের জন্য বিখ্যাত।

দর্শনীয় স্থান:

  • নোহকালিকাই জলপ্রপাত: ভারতের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত।
  • সেভেন সিস্টারস ফলস: সাতটি জলপ্রপাতের মিলিত দৃশ্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়।
  • মৌসমাই গুহা: সুপরিচিত চুনাপাথরের গুহা, যেখানে আকর্ষণীয় স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট দেখা যায়।
  • ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ: প্রকৃতির তৈরি এক অপূর্ব জীবন্ত শিকড়ের সেতু।

৩. মাওলিনং – এশিয়ার পরিচ্ছন্নতম গ্রাম

মেঘালয়ের মাওলিনং গ্রাম তার পরিচ্ছন্নতা ও সুন্দর পরিবেশের জন্য বিখ্যাত।

দর্শনীয় স্থান:

  • স্কাই ওয়াক (Sky View Tower): বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়।
  • লিভিং রুট ব্রিজ: এখানেও একক লিভিং রুট ব্রিজ রয়েছে।

৪. দাউকি – স্বচ্ছ নদীর দেশ

দাউকি গ্রাম তার স্বচ্ছ জলের নদী উমগট নদীর জন্য বিখ্যাত।

দর্শনীয় স্থান:

  • উমগট নদীতে বোটিং: জলের স্বচ্ছতার কারণে নৌকা যেন বাতাসে ভাসছে মনে হয়।
  • বাংলাদেশ সীমান্ত (তামাবিল বর্ডার): ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত দেখা যায়।

৫. মাওসিনরাম – পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের স্থান

এই স্থানটি চেরাপুঞ্জির থেকেও বেশি বৃষ্টিপাত পায়। বর্ষাকালে ঘুরতে গেলে দারুণ অভিজ্ঞতা হয়।

৬. নংখলিয়াট গুহা ও ক্রেম লিয়াট প্রাহ গুহা

গুহা অভিযানের জন্য এগুলো অন্যতম সেরা স্থান, যেখানে ৩০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত গুহা আছে।


মেঘালয়ে কী কী করা যায়?

  1. ট্রেকিং:
    • রুট ব্রিজ ট্রেক (চেরাপুঞ্জি)
    • ডেভিড স্কট ট্রেইল (শিলং)
    • ক্রেম লিয়াট প্রাহ গুহা ট্রেক
  2. অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস:
    • উমিয়াম লেকে কায়াকিং ও বোটিং
    • দাউকিতে স্কুবা ডাইভিং ও স্নোরকেলিং
  3. আদিবাসী সংস্কৃতি ও খাদ্য উপভোগ:
    • খাসি ও গারো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি জানার সুযোগ
    • বিখ্যাত খাবার: জাদো (মাংস ও চালের খাবার), দোহ খলসেইন, দোহ থলেইন

বাজেট পরিকল্পনা

প্রতি ব্যক্তির আনুমানিক বাজেট (৫ দিনের জন্য)

  • হোটেল: ₹১৫০০–₹৫০০০ (প্রতি রাত)
  • খাবার: ₹৩০০–₹১০০০ (প্রতি দিন)
  • পরিবহন: ₹৩০০০–₹৭০০০
  • অ্যাডভেঞ্চার: ₹১০০০–₹৫০০০
  • মোট আনুমানিক বাজেট: ₹১০,০০০–₹২৫,০০০ (ব্যক্তি পিছু)

শেষ কথা

মেঘালয় প্রকৃতির এক অনন্য আশীর্বাদ। এই রাজ্যের প্রতিটি কোণায় লুকিয়ে আছে অদ্ভুত সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ। যদি আপনি প্রকৃতির সান্নিধ্যে গিয়ে নির্ভেজাল আনন্দ নিতে চান, তবে মেঘালয় নিঃসন্দেহে আপনার জন্য আদর্শ গন্তব্য!

banglablogs.in ©️ 2025
All rights reserved

Leave a comment