বাংলা সংস্কৃতিতে দোল বা হোলি উৎসব

Spread the love

হোলি বা দোল, বাংলা সংস্কৃতিতে এক অতি জনপ্রিয় এবং আনন্দমুখর উৎসব। এটি বিশেষ করে ভারতে এবং বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বেশ ঘটা করে পালিত হয়। দোল বা হোলি, রঙের উৎসব হিসেবেই বেশি পরিচিত, যেখানে মানুষের মধ্যে একে অপরকে রঙ দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। এই উৎসবের মাধ্যমে সমাজের মধ্যে ভালবাসা, সৌহার্দ্য এবং ভ্রাতৃত্বের বার্তা পৌঁছানো হয়।

বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলসহ কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে হোলি বা দোল অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বহু বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে। এই ব্লগে আমরা দোল বা হোলির উৎসবের ইতিহাস, বাংলায় এর গুরুত্ব, এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু জনপ্রিয় রীতি ও ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করব।

হোলির ইতিহাস

হোলির উৎসব ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতির একটি অংশ। এটি সাধারণত ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয়, যা ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের মধ্যে পড়ে। হোলির উৎসবের বিভিন্ন ধর্মীয় ও পৌরাণিক ব্যাখ্যা রয়েছে। বিশেষত, হোলি বা দোলের উৎসবের শুরু হয় ‘হোলিকা দহন’ বা ‘হোলিকা পোড়ানো’ দিয়ে, যা রাক্ষসী হোলিকার মৃত্যু এবং ভগবান বিষ্ণুর কৃপা প্রদর্শনকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ কাহিনী।

হোলিকা দহন ও প্রহ্লাদ

পৌরাণিক কাহিনীতে উল্লেখ আছে, রাক্ষস রাজা হিরণ্যকশিপু তার ছেলে প্রহ্লাদকে শাস্তি দেওয়ার জন্য হোলিকা নামক এক রাক্ষসীকে পাঠান। হোলিকা আগুনে বসে প্রহ্লাদকে বুকে জড়িয়ে নিবে, যাতে সে পুড়ে মারা যায়। কিন্তু প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন এবং তিনি ভগবানের স্মরণ করতে থাকেন। অবশেষে, ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় হোলিকা পুড়ে মারা যায় এবং প্রহ্লাদ বেঁচে যান। এই ঘটনা আজও হোলি উৎসবের সময় ‘হোলিকা দহন’ বা ‘হোলিকা পোড়ানো’ আয়োজিত হয়, যা সত্যের জয়ের এবং মিথ্যার পরাজয়ের প্রতীক।

বাংলায় দোল বা হোলি

বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে হোলি বা দোল উৎসব বেশ আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এখানে হোলি শুধু একটি আনন্দের উৎসব নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। বিশেষ করে, বাংলা নববর্ষের শুরুতে এই উৎসবটি আরও বেশি আনন্দের সাথে পালন করা হয়।

দোলযাত্রা

বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল এবং কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ‘দোলযাত্রা’ খুবই জনপ্রিয়। দোলযাত্রা মূলত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা হোলি উৎসবের আগের দিন বা পূর্ণিমার রাতে অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষত, মন্দিরে ভগবান কৃষ্ণের মূর্তির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তাদের সামনে রঙ ও ফুল ছড়ানো হয়। কৃষ্ণ ভক্তরা এই সময় শ্রীকৃষ্ণের রূপে সাজে এবং একে অপরকে রঙের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানায়।

রঙের খেলা

দোলের মূল আকর্ষণ হলো রঙের খেলা। একে অপরকে রঙ দিয়ে সাজানো এবং পরস্পরের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করা একটি প্রাচীন রীতি। এই রঙের খেলা একদিকে যেমন আনন্দের, তেমনি এটি একটি সামাজিক বন্ধনও সৃষ্টি করে। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ মুছে যায় এবং সবাই একে অপরের সাথে আনন্দের মধ্যে মেতে ওঠে।

দোল বা হোলি উৎসবের ঐতিহ্য

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে হোলি বা দোল পালনের বিশেষ কিছু ঐতিহ্য রয়েছে। এখানে কিছু জনপ্রিয় ঐতিহ্য আলোচনা করা হলো:

১. শ্রীকৃষ্ণের বন্দনা

হোলি উৎসবের সঙ্গে কৃষ্ণ ভক্তি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কৃষ্ণের প্রেমিকা রাধার প্রতি তাঁর ভালবাসা এবং গোপীদের সঙ্গে মিষ্টি সম্পর্কের কারণেই হোলি উদযাপিত হয়। হোলি উৎসবের সময়, অনেক জায়গায় শ্রীকৃষ্ণের মূর্তির সামনে পুষ্পবৃষ্টি ও রঙ খেলা হয়।

২. দোলযাত্রা এবং গান

বাংলায় দোলযাত্রা একটি বড় সামাজিক উৎসব হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে ভক্তরা শ্রীকৃষ্ণের গানে মেতে ওঠে। বিশেষ করে ‘রাধা-কৃষ্ণ’ সম্পর্ক নিয়ে গান গাওয়া হয়। কলকাতা ও এর আশেপাশের এলাকায় বিভিন্ন শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরে এই ধরনের গানের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

৩. স্নান ও হোলিকা দহন

হোলির আগের দিন, ‘হোলিকা দহন’ এক গুরুত্বপূর্ণ আচার। মন্দিরের সামনে বড় একটি আগুন জ্বালানো হয়, যাতে দুষ্ট শক্তি এবং সকল অশুভ শক্তি বিনষ্ট হয়। এই আগুনে মানুষ নিজেদের শরীরও পরিষ্কার করতে চান, যাতে তারা নতুন এক শুভ সূচনা করতে পারেন।

হোলির সঙ্গে সম্পর্কিত খাবার

হোলি উৎসবের সঙ্গে কিছু বিশেষ খাবারের সম্পর্ক রয়েছে। এই সময়, বিশেষত মিষ্টান্নের মধ্যে ‘গোলাপ জামুন’, ‘মিষ্টি দই’ এবং ‘পুলি’ বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া, হোলি উপলক্ষে ‘বুন্দিয়া’ ও ‘পাটিসাপটা’ও বানানো হয়। এই খাবারের মধ্যে এক ধরনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

হোলি বা দোল উৎসব শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি সমাজের মধ্যে একতা ও সৌহার্দ্যের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। এই সময়ে মানুষ সকল ধর্ম, বর্ণ ও জাতির পার্থক্য ভুলে যায় এবং একে অপরকে রঙের মাধ্যমে আনন্দ দেয়। বিশেষ করে, এই উৎসব তরুণদের মধ্যে একটি নতুন ধরনের বন্ধন তৈরি করে, যা তাদের সামাজিক জীবনে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।

শেষ কথা

দোল বা হোলি, এক অতি আনন্দদায়ক এবং উজ্জ্বল উৎসব যা বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি রঙের উৎসব নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানও বটে। এই উৎসব মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, সৌহার্দ্য ও একতার বার্তা পৌঁছায় এবং এটি প্রতিটি মানুষকে একত্রিত করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

অতএব, হোলি বা দোল আমাদের জীবনে নতুন সূচনা এবং পুনঃপ্রকাশের প্রতীক হিসেবে থাকুক। এর আনন্দ ও রঙের খেলা আমাদের সকলের মধ্যে একতা ও ভালোবাসার বন্ধন আরও দৃঢ় করুক।

banglablogs.in ©️ 2025
All rights reserved

Leave a comment