🇮🇳 বাংলার অজানা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাহিনি – বিস্মৃত বীরদের গল্প

ভূমিকা: ইতিহাসের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা সংগ্রামী

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বাংলার অবদান অসামান্য। কিন্তু খুদিরাম বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চাকি— এই কয়েকটি নাম ছাড়া বহু বীর বিপ্লবীর কাহিনি আজ প্রায় বিস্মৃত।
তাঁরা ছিলেন সমান সাহসী, সমান ত্যাগী, এবং সমান দেশপ্রেমিক। এই লেখায় আমরা ১০ জন কম পরিচিত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও তাঁদের অনন্য অবদানের গল্প তুলে ধরব।

১) বিনয় বসু: মৃত্যুকে হাসিমুখে গ্রহণ করা বীর

১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ার (বর্তমান কর্নওয়ালিস স্ট্রিট) পুলিশ সদর দপ্তরে প্রবল আক্রমণ চালান বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দিনেশ গুপ্ত।
তাদের লক্ষ্য ছিল কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট এবং সিম্পসন, যারা স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে চরম নিষ্ঠুর ছিলেন।
অভিযানে সিম্পসন নিহত হলেও বিনয় ও তাঁর সঙ্গীরা পালাননি।
ব্রিটিশ সেনারা ঘিরে ফেললে, বিনয় বিষপান করেন, যাতে তাঁকে জীবিত বন্দি করা না যায়।

২) মাতঙ্গিনী হাজরা: ‘গান্ধী বুড়ি’-র শেষ পদযাত্রা

১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ৭৩ বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা পতাকা হাতে কন্টাই থানার দিকে পদযাত্রা করেন।
পুলিশ গুলি চালালে তাঁর শরীরে তিনটি গুলি লাগে, কিন্তু পতাকা নামতে দেননি।
শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল— “বন্দে মাতরম”।
আজ তমলুকে তাঁর মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, হাতে উঁচু করা জাতীয় পতাকা।

৩) ত্রিলোক্য দত্ত: বিপ্লবী ডাকাতির সাহসী মুখ

যুগান্তর দলের সক্রিয় কর্মী ত্রিলোক্য দত্ত ১৯০৭ সালে ব্রিটিশ ডাকঘরে সশস্ত্র ডাকাতি চালান।
এর মাধ্যমে সংগঠনের জন্য বিপুল অর্থ সংগ্রহ হয়।
তিনি একাধিকবার গ্রেফতার হলেও স্বাধীনতার স্বপ্ন ত্যাগ করেননি।

৪) কানাইলাল দত্ত: কারাগারে গুলি চালানো বিপ্লবী

১৯০৮ সালের আলিপুর বোমা মামলায় বন্দি অবস্থায় কানাইলাল দত্ত নরেন্দ্র গোস্বামী নামে এক বিশ্বাসঘাতককে জেলের ভেতরে গুলি করে হত্যা করেন।
২০ বছর বয়সে তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
তাঁর শেষ কথা ছিল— “বন্দে মাতরম”।

৫) সুনীতি চৌধুরী: ভারতের কনিষ্ঠতম বিপ্লবী হত্যাকারী

মাত্র ১৬ বছর বয়সে সুনীতি চৌধুরী নোয়াখালির ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সি.বি. স্টিভেনসকে গুলি করে হত্যা করেন।
বিদ্যালয়ের প্রার্থনার সময় তিনি এই সাহসী কাজ করেন।
তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলেও স্বাধীনতার পর মুক্তি পান।

৬) অনন্ত সিং: করাচি ষড়যন্ত্র মামলার বীর

১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন অভিযানে অংশ নেন অনন্ত সিং।
পরে করাচি ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়, যা পরে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বদল হয়।
তিনি আন্দামান সেলের কঠিন নির্যাতন সহ্য করেন।

৭) প্রেমানন্দ মিত্র: গুপ্ত সংবাদ বাহকের ভূমিকা

প্রেমনান্দ মিত্র ছিলেন বিপ্লবী সংগঠনের একজন দক্ষ বার্তাবাহক।
তিনি বহুবার ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে অস্ত্র ও গোপন তথ্য পরিবহন করেছেন।
তাঁর গল্প প্রমাণ করে, স্বাধীনতার জন্য মাঠে লড়াই যেমন দরকার, তেমনই দরকার নেপথ্যের কাজও।

৮) প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার: নারী বিপ্লবের প্রতীক

১৯৩২ সালে চট্টগ্রামে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে নেতৃত্ব দেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
ক্লাবের গায়ে লেখা ছিল— “Dogs and Indians not allowed”।
অভিযান শেষে গ্রেফতার এড়াতে সায়ানাইড খেয়ে শহীদ হন।

৯) বীণা দাস: গভর্নরের দিকে গুলি চালানো শিক্ষার্থী

১৯৩২ সালে কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ বেঙ্গল গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনের দিকে গুলি চালান বীণা দাস।
যদিও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, তাঁর সাহসিকতা গোটা বাংলায় আলোড়ন তোলে।

১০)  রামকৃষ্ণ বিশ্বাস: হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে

যুগান্তর দলের কর্মী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস পুলিশ অফিসার ল্যাম্বকে হত্যা করেন।
ফাঁসির আগে তিনি গান গাইতে গাইতে মৃত্যুবরণ করেন, যা তাঁর অদম্য সাহসের প্রমাণ।

উপসংহার: বিস্মৃত বীরদের আলোয় ফেরানো

এই অজানা বীরদের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা অর্জন কেবল কয়েকজন নেতার প্রচেষ্টায় নয়, অসংখ্য ত্যাগী মানুষের রক্ত ও ঘামে সম্ভব হয়েছে।

• WordPress

banglablogs.in ©️ 2025
All rights reserved