ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অধিনায়ক হিসেবে পরিচিত সৌরভ গাঙ্গুলী। তিনি শুধু দুর্দান্ত ব্যাটসম্যানই নন, একজন সফল নেতা হিসেবেও ভারতীয় দলকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। ক্রিকেটের মাঠে তার আগ্রাসী মনোভাব এবং নেতৃত্বের দক্ষতা ভারতীয় ক্রিকেটকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করিয়েছে। “প্রিন্স অব কলকাতা” নামে খ্যাত এই কিংবদন্তির জীবন কাহিনী জানতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে তার শৈশব, ক্রিকেট কেরিয়ার, নেতৃত্ব এবং অবসরের পরবর্তী জীবনের দিকে।
শৈশব ও প্রাথমিক জীবন
সৌরভ চন্দ্র গাঙ্গুলী জন্মগ্রহণ করেন ৮ জুলাই ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়, এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারে। তার পিতা চন্ডী গাঙ্গুলী একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত ভালো ছিল। ছোটবেলা থেকেই সৌরভ খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন, তবে তার মা চেয়েছিলেন তিনি পড়াশোনার দিকে বেশি মনোযোগ দিন।
সৌরভের বড় ভাই স্নেহাশীষ গাঙ্গুলী একজন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার ছিলেন, যার অনুপ্রেরণায় সৌরভ ক্রিকেটের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি দক্ষিণ কলকাতার বিদ্যানগর স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলায় ডানহাতি হলেও, দাদার ব্যাট ব্যবহার করার কারণে তিনি বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠেন।
ক্রিকেট কেরিয়ারের শুরু
সৌরভ গাঙ্গুলীর ক্রিকেট কেরিয়ার শুরু হয় ১৯৮৯ সালে, যখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন। ১৯৯০-৯১ সালের রঞ্জি ট্রফিতে তিনি দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন এবং তার ব্যাটিং প্রতিভা সকলের নজরে আসে।
১৯৯২ সালে, তিনি প্রথমবার ভারতের জাতীয় দলের হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক (ODI) ক্রিকেটে অভিষেক করেন, কিন্তু প্রথম ম্যাচে ভালো করতে পারেননি এবং দল থেকে বাদ পড়েন। তবে তিনি হাল ছাড়েননি, ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে ফের জাতীয় দলে প্রত্যাবর্তন করেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উত্থান
১৯৯৬ সালে ভারতের ইংল্যান্ড সফরে, সৌরভ গাঙ্গুলী টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক করেন এবং তার অভিষেক ম্যাচেই লর্ডসের মাঠে দুর্দান্ত ১৩১ রানের ইনিংস খেলেন। এই ইনিংসটি তাকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে দেয়। এরপর পরের ম্যাচেও তিনি সেঞ্চুরি করেন, যা তাকে দলের অপরিহার্য সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
তাঁর ব্যাটিং স্টাইল ছিল আকর্ষণীয় এবং আত্মবিশ্বাসী। কভার ড্রাইভ তার বিশেষত্ব ছিল, যা দেখে ক্রিকেটপ্রেমীরা মুগ্ধ হতেন। একদিনের ক্রিকেটেও তিনি দ্রুত একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠেন এবং সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে ওপেনিং জুটি গড়ে ভারতের অন্যতম সফল ওপেনিং পার্টনারশিপ তৈরি করেন।
ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব
২০০০ সালে, ভারতীয় ক্রিকেট এক দুর্নীতির ছায়ায় পড়েছিল—ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারি গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। এই সময় ভারতীয় দল নতুন নেতৃত্বের সন্ধানে ছিল, আর সেই সময় অধিনায়কের দায়িত্ব নেন সৌরভ গাঙ্গুলী।
তার নেতৃত্বে ভারতীয় দল এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। তিনি দলকে লড়াকু মানসিকতা শেখান, তরুণ খেলোয়াড়দের সুযোগ দেন এবং ভারতীয় ক্রিকেটকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলেন।
অধিনায়ক সৌরভের কিছু বড় সাফল্য:
- ২০০১ সালের ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ: এই সিরিজে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং রাহুল দ্রাবিড়ের ঐতিহাসিক ইনিংস ভারতের এক অবিস্মরণীয় জয় এনে দেয়। সৌরভের নেতৃত্বে ভারত ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জেতে।
- ২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ: ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফাইনালে যুবরাজ সিং এবং মোহাম্মদ কাইফের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ভারতকে জেতায়। ম্যাচের শেষে সৌরভ গাঙ্গুলীর লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি উড়িয়ে দেওয়ার মুহূর্ত ক্রিকেট ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
- ২০০৩ বিশ্বকাপ: ভারতকে বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে যান, যেখানে ভারতীয় দল অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে গেলেও তাদের পারফরম্যান্স দারুণ ছিল।
- ২০০৪ পাকিস্তান সফর: পাকিস্তানের মাটিতে ভারত ১৯ বছর পর টেস্ট সিরিজ জেতে, যা সৌরভের অধিনায়কত্বের আরেকটি বড় সাফল্য।
অধিনায়কত্ব হারানো এবং প্রত্যাবর্তন
২০০৫ সালে, গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে সৌরভ গাঙ্গুলী অধিনায়কের পদ হারান এবং দল থেকেও বাদ পড়েন। এটি তার কেরিয়ারের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল। তবে তিনি হাল ছাড়েননি এবং ২০০৬ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের মাধ্যমে জাতীয় দলে ফিরে আসেন।
২০০৭ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তিনি আবার দলে ফিরে আসেন এবং ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলে প্রমাণ করেন যে তিনি এখনও ভারতের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। ২০০৭ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে তিনি ডাবল সেঞ্চুরি করেন, যা তার প্রত্যাবর্তনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর
২০০৮ সালে, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজের সময় সৌরভ গাঙ্গুলী ঘোষণা করেন যে এটি তার শেষ সিরিজ হবে। নাগপুর টেস্টে তিনি তার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন এবং তার কেরিয়ার শেষ হয় ভারতের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান এবং অধিনায়ক হিসেবে।
তার টেস্ট পরিসংখ্যান:
- ম্যাচ: ১১৩
- রান: ৭,২১২
- গড়: ৪২.১৭
- সেঞ্চুরি: ১৬
তার একদিনের ক্রিকেট পরিসংখ্যান:
- ম্যাচ: ৩১১
- রান: ১১,৩৬৩
- গড়: ৪১.০২
- সেঞ্চুরি: ২২
অবসরের পর জীবন
অবসরের পর সৌরভ গাঙ্গুলী ক্রিকেট প্রশাসনে যুক্ত হন। ২০১৫ সালে তিনি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল (CAB)-এর সভাপতি হন। ২০১৯ সালে তিনি বিসিসিআই-এর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ভারতীয় ক্রিকেটের প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ক্রিকেট বিশ্লেষক হিসেবে তিনি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছেন এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
সৌরভ গাঙ্গুলীর স্ত্রী ডোনা গাঙ্গুলী একজন বিশিষ্ট ওডিশি নৃত্যশিল্পী। তাদের একমাত্র কন্যা সানা গাঙ্গুলী। তিনি পরিবারকে সবসময় গুরুত্ব দেন এবং তার ব্যস্ত ক্রিকেট কেরিয়ারের মাঝেও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।
উপসংহার
সৌরভ গাঙ্গুলী শুধু একজন সফল ক্রিকেটারই নন, তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের সংস্কৃতিও বদলে দিয়েছেন। তার নেতৃত্বের সময় ভারতীয় দল আগ্রাসী, আত্মবিশ্বাসী এবং লড়াকু মানসিকতা অর্জন করে। তার অবদান ভারতীয় ক্রিকেটে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আজও, তরুণ ক্রিকেটাররা তার জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নেয় এবং তার সাফল্যের গল্প ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে অমর হয়ে থাকবে।
banglablogs.in ©️ 2025
All rights reserved