কালী পূজা ও দীপাবলি: পশ্চিমবঙ্গের আলো ও শক্তির উৎসব

Spread the love

ভূমিকা

অন্ধকারের মধ্যেই এক আলোকোজ্জ্বল উত্সব। নবরাত্রির পরে আসে কালী পূজা — সন্ধ্যার ক্ষণে মণি-আলো, প্রদীপ, ধূপ-ধুনো আর মন্ত্রকীর্তনের মাধ্যমে মা কালীকে স্মরণ করা হয়। একই সঙ্গে দেশজুড়ে পালন করা হয় দীপাবলি — বিজয়ের, আলোর ও সমৃদ্ধির উৎসব। পশ্চিমবঙ্গের কালী পূজা ও দীপাবলি যাকে বলে—ধর্মীয় অনুশাসন ও লোকাচার একত্রে মিশে গড়ে তোলে অনন্য রীতিনীতি। এই ব্লগে আমরা কালী পূজা ও দীপাবলির ইতিহাস, পৌরাণিক সূত্র, পূজার রীতিনীতি, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক তাৎপর্য এবং আধুনিক পরিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

ইতিহাস ও উৎপত্তি

কালী পূজার উৎস বহুপ্রাচীন। বাংলা অঞ্চলের মঠ-মন্দির, তন্ত্রাচার্য ও লোকশাস্ত্রে কালীকে শক্তি রূপে আর ভয়ের দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তন্ত্রপ্রথায় কালীকে কথিতভাবে ‘অন্ত্যজগতের বিধ্বংসী’ ও ‘অহঙ্কার-দমনকারী’ দেবী বলা হয়। কালী পূজার প্রাথমিক রূপগুলি হয়ত সন্ন্যাসী-তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের মধ্যেই শুরু — যেখানে অন্ধকারে, সমুদ্রতীর বা নির্জন স্থলে দেবীর আরাধনা করা হতো। ইতিহাসে ১৮-১৯ শতকে, বাঙালি গুরুপূত কর্মকাণ্ড ও সমাজনীতির বদলে কালী পূজা লোকপ্রিয়তা পর্যন্ত পৌঁছে — পণ্ডিতরা, জমিদাররা ও সাধারণ পরিবার একসঙ্গে দেবীর আরাধনায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন।

দীপাবলির উৎপত্তি হিন্দু পুরাণে বিভিন্ন কাহিনীর সঙ্গে জড়িত। রামায়ণের সূত্রে রামচন্দ্রের অরণ্যবাস ও রাবণের পরাজয়ের পরে অযোধ্যায় ফেরার দিনে নাগরিকরা প্রদীপ জ্বালিয়ে আনন্দ উদযাপন করেছিলেন—এই ঘটনার স্মৃতিতেই বিস্তৃত ভারতে দীপাবলি পালিত হয়। এজন্য অন্য অঞ্চলে প্রধানত রাম-লক্ষ্মী-যমদূত/কুবের সম্পর্কিত পূজা হলেও বাংলা অঞ্চলে কালী পূজা ও দীপাবলির সমন্বয় দেখা যায় — ফলে পশ্চিমবঙ্গের লোকাচারে কালী ও লক্ষ্মী দুই দেবীর উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।

পৌরাণিক কাহিনি ও দেবীর রূপ

কালী সাধারণত দুর্গার একটি রূপ — অগ্নি, তেজ ও রুদ্র শক্তির সংমিশ্রণ। দেবীকে গ্রাসীভূত, অসীম শক্তিশালী ও ভয়ানক রূপেও চিত্রিত করা হয়: কালো রং, লেজে সামান্য চুল, নতজানু ও জিহ্বা বেরিয়ে থাকা, হাতে অস্ত্র ও করুণ-রক্তে রেণু — কিন্তু তাঁর মূল কাজ হল দুষ্ট শক্তিকে বিনাশ করা ও ধার্মিকদের রক্ষা করা। লোকবিশ্বাসে কালী দুঃখ-অশুভ সব ধ্বংস করে সুখ, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা দেন। এ কারণেই কালী পূজা অন্ধকারে ও ঝকঝকে প্রদীপের মাঝে পালিত হয়—অন্ধকারের মধ্যে দেবীর আলোর প্রতীকী জয়।

পূজার সময় ও রীতিনীতি

কালী পূজা সাধারণত কার্তিক মাসে (আশ্বিন-কার্তিক পরিবর্তন) লক্ষ্মীপূজার সময়ের আশেপাশে অনুষ্ঠিত হয়, মূলত নবমী বা কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাতে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের কালী মন্দির থেকে শুরু করে কালীঘাট (কলকাতার কালী মন্দির) — সবখানেই বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান হয়। পূজার কিছু বিশেষ আয়োজন:

1. পূজা-সংস্কার ও প্রস্তুতি: পূজার কয়েক দিন আগেই বাড়ি-ঘর পরিষ্কার, আলোকসজ্জা, ব্যানার, প্যান্ডেল তৈরী। পন্ডাল বা মন্দিরে কালী মা-র প্রতিমা থাকলে তাকে নতুন সাজ, বসন ও অলঙ্কার দেওয়া হয়।

2. অন্তর্গত অনুষ্ঠান: পৌরাণিক মন্ত্রপাঠ, হোম/হবন, ধূপ-দীপ ও ফল-ফুল নিবেদন করা হয়। তন্ত্রাচার্যর নেতৃত্বে কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ রীতিতে কনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা হয়।

3. চন্ডীপাঠ : চন্ডীপাঠ বা শক্তিপাঠের বিশেষ অংশগুলি কালী আরাধনায় পড়া হয়—মন্ত্রের উচ্চারণে দেবীর অসীম শক্তি আহ্বান করা হয়।

4. খাদ্য ও ভোগ: ভোগে সাধারণত মিষ্টান্ন (রসগোল্লা, সন্দেশ ইত্যাদি), ভাত-ডাল, পায়েস ইত্যাদি দেওয়া হয়। অনেক বাড়িতে রাত-ভোজনের আয়োজন থাকে।

5. প্রদীপ ও আতশবাজি: রাত জেগে প্রদীপ জ্বালানো, শহরে প্যান্ডেলে আলোকসজ্জা, আতশবাজি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

6. লোকাচার ও ভোলাচাল: গ্রামের স্থানীয় কাহিনি, পঞ্চম-পূজার স্মৃতিচারণ, নৃত্য-গান ও নাটক হয় যা দেবীর কাহিনি ও সমাজের গল্প বলে।

কালী পূজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য

কালী পূজা শুধু ধর্মীয় ভাবেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি সামাজিক সংহতি, শিল্প-সাহিত্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বড় উৎসব। প্যান্ডেল সজ্জা, প্রতিমা-নির্মাণ, মিষ্টি ও খাবারের চাহিদা স্থানীয় শিল্পীদের ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাজ দেয়। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য যেমন লোকনৃত্য, মাঝরাতে নাটক-নাটিকা, ও স্থানীয় কীর্তন—সবকিছু মিলিয়ে উৎসবটি একটি বৃহৎ সামাজিক মঞ্চে পরিণত হয়।

কালীপ্রেমীরা তাঁদের ব্যাক্তিগত ভক্তি, ভীতিকর অনুজ্ঞা ও ধ্যানের মাধ্যমে এই উৎসবকে গ্রহণ করেন। অনেকের জন্য এটি আত্মশুদ্ধি ও দুর্ভাগ্য দূর করার সময়; আর একথাও বলতে চাই—নারীশক্তির সশক্ত প্রকাশও কালী পূজায় স্পষ্ট। কালী — প্রকৃতপক্ষে নানাবিধ ক্ষমতার প্রতীক, আর এই শক্তির সামনে মানুষের আশা-ভরসা ও আশ্বাস প্রকাশ পায়।

দীপাবলি বনাম কালী পূজা: পশ্চিমবঙ্গের পার্থক্য

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে দীপাবলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষ্মী-প্রধান: দোরগোড়ায় প্রদীপ, লাল-হলুদ রঙের সাজ, ব্যবসায়ীদের প্রতিবিম্ব। কিন্তু বাংলায় দীপাবলি ও কালী পূজা স্মরণীয়ভাবে একসাথে মিশে যায় — কার্তিক অমাবস্যার রাতে কালী পূজা হয় এবং পাশাপাশি বাড়ি-ঘরে আলোকসজ্জা ও লক্ষ্মীপূজার চর্চাও লক্ষ্য করা যায়। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গীয় দীপাবলি-পালন অন্য কোনো অঞ্চলের তুলনায় ধর্মীয় ও লোকাচারের মিশেলে ভিন্নতা প্রদর্শন করে।

খাদ্য, শিল্প ও বিনোদন

দীপাবলি-কালীন সময়ে মিষ্টি ও খাবারের আয়োজন ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। পাপড়, দই-মিষ্টি, সন্দেশ, রসগোল্লা ইত্যাদি — এই সময়ের অঙ্গ। প্যান্ডেল-সংস্কৃতি, প্রতিমা নির্মাণে কাঁচামাল শিল্পীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। থিয়েটার, লোকনৃত্য, কীর্তন ও গানের সন্ধ্যায় মানুষের সচ্ছল উপস্থিতি উৎসবকে দারুণ প্রাণবন্ত করে তোলে।

আধুনিকীকরণ ও পরিবেশগত সচেতনতা

গত কয়েক বছরে কালী পূজায় আধুনিকতা এসে গেছে — ইলেকট্রনিক লাইটিং, ডিজে-সাহারা, আলোকসজ্জায় নতুন পদ্ধতি। তবে একই সঙ্গে পরিবেশগত দিকটাও গুরুত্ব পাচ্ছে: প্লাস্টিক-কম, বর্জ্য-পরিবেশবান্ধব প্রতিমা, বিস্ফোরক-কম আতশবাজির প্রচেষ্টা। অনেক প্যান্ডেল এখন পরিবেশ বান্ধব উপকরণ ব্যবহার করছে, যাতে উৎসব থাকুক কিন্তু প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

অর্থনৈতিক প্রভাব

পশ্চিমবঙ্গের কালী পূজা ও দীপাবলি স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে — মিষ্টি শিল্প, হস্তশিল্প, আলোকসজ্জা ব্যবসা, আতশবাজি বিক্রেতা, মন্দির-প্রতিমা শিল্পীরা সকলেই উপকার পান। গ্রাম-শহরের শ্রেণিবিভেদ নির্বিশেষে এই মৌসুমি চাহিদা শ্রমিকদের কাজ দেয় ও ক্রেতাদের অর্থচক্র সক্রিয় করে।

উল্লেখযোগ্য কালী মন্দির ও উৎসব-স্থল

কলকাতার কালীঘাট মন্দির, দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির, তারাপীঠ, বর্ধমানের কালি মন্দির, নদীয়ার কালী মেলা — এইসব স্থানের নাম শুনলেই কালী পূজার শান্ত ও ভক্তিময় আভা মনে পড়ে। প্রতিটি জায়গার নিজস্ব রীতিনীতিতে পূজা হয়; শহরের প্যান্ডেল-কল্যাণে থিম-ভিত্তিক প্রতিমা তৈরি করা হয়, গ্রামে স্থানীয় মন্দির-আচার চলছে।

সমাপ্তি: কালী ও আলোর মিলন

কালী পূজা ও দীপাবলি—পূজার অমাবস্যার রাত থেকে আলোর বিজয়ের দিন পর্যন্ত—এটি কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাঙালির আত্মা ও সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কালী দেবীর রূপ, শক্তি ও করুণা মানুষের হৃদয়ে ভিন্ন প্রতিফলন ফেলে; অন্যদিকে প্রদীপ-আলোকিত দীপাবলি আশা, সমৃদ্ধি ও সামাজিক সংহতির প্রতীক। এই দুইয়ের সমন্বয়েই পশ্চিমবঙ্গের কার্তিক মাসটি এক অনন্য রূপ নেয় — যে রূপ হৃদয় জ্বালায়, সমাজকে একত্র করে ও শিল্প-সংস্কৃতিকে বিকশিত করে।

banglablogs.in ©️ 2025
All rights reserved

Leave a comment