সেমিকন্ডাক্টর: আধুনিক প্রযুক্তির হৃদস্পন্দন

Spread the love

ভূমিকা

বর্তমান বিশ্বের প্রযুক্তি নির্ভর জীবনে সেমিকন্ডাক্টর (Semiconductor) একটি অপরিহার্য উপাদান। আমাদের মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে কম্পিউটার, গাড়ি, মেডিকেল যন্ত্রপাতি এমনকি ঘরের স্মার্ট হোম অ্যাপ্লায়েন্স—সবকিছুতেই সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয়। একে ২১ শতকের “তেল” বা “নতুন স্বর্ণ” বললেও ভুল হবে না, কারণ আধুনিক শিল্প ও অর্থনীতির গতি অনেকাংশে নির্ভর করে সেমিকন্ডাক্টরের উপর।

সেমিকন্ডাক্টর কী?

“সেমিকন্ডাক্টর” শব্দটির অর্থ হলো অর্ধপরিবাহী পদার্থ। এটি এমন এক ধরনের পদার্থ যার বিদ্যুৎ পরিবাহিতা (conductivity) ধাতুর মতো বেশি নয় আবার নিরোধকের (insulator) মতো একেবারেই কমও নয়।

পরিবাহী (Conductor): যেমন তামা, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি যেখানে সহজেই বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়।

নিরোধক (Insulator): যেমন কাঠ, রাবার, প্লাস্টিক—যেখানে বিদ্যুৎ প্রায় প্রবাহিত হয় না।

অর্ধপরিবাহী (Semiconductor): যেমন সিলিকন, জার্মেনিয়াম—এরা বিশেষ পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে আবার বিশেষ অবস্থায় পরিবাহিতা বন্ধ করে দেয়।

এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণেই সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে তৈরি ডিভাইসগুলো (যেমন ট্রানজিস্টর, ডায়োড, মাইক্রোচিপ) আধুনিক প্রযুক্তির মূল ভিত্তি।

সেমিকন্ডাক্টর কীভাবে তৈরি হয়?

সেমিকন্ডাক্টর তৈরির প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও সূক্ষ্ম। সাধারণত সিলিকন (Silicon) সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় (বালিতে এর উপস্থিতি আছে) এবং এর বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্য খুবই উপযোগী।

ধাপসমূহ:

1. কাঁচামাল সংগ্রহ:

সিলিকন বালি (Silica Sand) থেকে পরিশোধিত হয়।

এই সিলিকনকে উচ্চ তাপমাত্রায় প্রক্রিয়াজাত করে বিশুদ্ধ সিলিকন ইনগট (Ingot) তৈরি করা হয়।


2. ওয়েফার (Wafer) তৈরি:

সিলিকন ইনগটকে খুব পাতলা আকারে কেটে ছোট ছোট চাকার মতো স্লাইস তৈরি করা হয়। এগুলোকে বলা হয় “সেমিকন্ডাক্টর ওয়েফার”।


3. ডোপিং (Doping):

সিলিকনের পরিবাহিতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এতে ফসফরাস, বোরন ইত্যাদি পদার্থ মেশানো হয়।

এতে করে সিলিকনের ভেতরে ইলেকট্রন বা হোল (electron hole) তৈরি হয়, যা বিদ্যুৎ প্রবাহের ধরণ নিয়ন্ত্রণ করে।


4. ফটোলিথোগ্রাফি (Photolithography):

বিশেষ আলো ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওয়েফারের উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সার্কিট ডিজাইন করা হয়।

একেকটি সার্কিট কয়েক ন্যানোমিটার আকারের হতে পারে।

5. এচিং ও ডিপোজিশন:

অপ্রয়োজনীয় অংশ সরিয়ে ফেলা হয় এবং প্রয়োজনীয় উপাদান বসানো হয়।

ফলে মাইক্রোপ্রসেসর, মেমোরি চিপ ইত্যাদির নকশা তৈরি হয়।

6. টেস্টিং ও প্যাকেজিং:

প্রতিটি চিপ ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয়।

এরপর প্লাস্টিক বা সিরামিক কেসিংয়ের ভেতরে প্যাক করে বাজারে সরবরাহ করা হয়।

আধুনিক শিল্পে সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার


১. ইলেকট্রনিক্স শিল্প

মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ট্যাবলেট সবকিছুতেই প্রসেসর ও মেমোরি চিপ থাকে।

টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওভেনের মতো গৃহস্থালি যন্ত্রপাতিতেও সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয়।

২. টেলিকমিউনিকেশন

4G, 5G নেটওয়ার্কের বেস স্টেশন থেকে শুরু করে স্মার্টফোনের নেটওয়ার্ক মডিউল—সবকিছুতেই সেমিকন্ডাক্টর।

স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও এটি অপরিহার্য।

৩. অটোমোবাইল শিল্প

আধুনিক গাড়িতে সেন্সর, কন্ট্রোল ইউনিট, জিপিএস সিস্টেম, বৈদ্যুতিক ব্যাটারি ম্যানেজমেন্ট—সবই সেমিকন্ডাক্টরের উপর নির্ভরশীল।

বৈদ্যুতিক গাড়ি (EV) ও স্বয়ংচালিত গাড়ি (Autonomous Vehicle)-এ এর চাহিদা আরও বেশি।

৪. চিকিৎসা প্রযুক্তি

এমআরআই, সিটি স্ক্যান, আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন, পেসমেকার—এসব যন্ত্রে সেমিকন্ডাক্টর অপরিহার্য।

কোভিড মহামারির সময় ভেন্টিলেটর ও অন্যান্য ডিভাইস তৈরিতেও এর ব্যবহার বেড়েছে।

৫. ডিফেন্স ও মহাকাশ গবেষণা

রাডার, ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, মহাকাশযান, স্যাটেলাইট—এসব ক্ষেত্রে সেমিকন্ডাক্টরের প্রযুক্তি ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়।

বিশ্ব অর্থনীতিতে সেমিকন্ডাক্টরের গুরুত্ব

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সেমিকন্ডাক্টরের বাজার ট্রিলিয়ন ডলারের। যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, জাপান ও চীন—এই দেশগুলো সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন ও গবেষণায় অগ্রগামী।

তাইওয়ান: TSMC (Taiwan Semiconductor Manufacturing Company) বিশ্বের সবচেয়ে বড় চিপ প্রস্তুতকারক।

দক্ষিণ কোরিয়া: Samsung, SK Hynix মেমোরি চিপের জন্য বিখ্যাত।

যুক্তরাষ্ট্র: Intel, Qualcomm, Nvidia প্রসেসর ও GPU ক্ষেত্রে শীর্ষে।

ভারতও এখন সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে বড় ভূমিকা নিতে চাইছে। “Make in India” ও “Digital India” কর্মসূচির অধীনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

১. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও মেশিন লার্নিং

AI চালাতে শক্তিশালী প্রসেসর দরকার, যেখানে GPU ও নিউরোমরফিক চিপ ব্যবহার হয়। আগামীতে AI-ভিত্তিক ডিভাইসগুলোর জন্য সেমিকন্ডাক্টরের চাহিদা আরও বাড়বে।

২. ইন্টারনেট অব থিংস (IoT)

স্মার্ট হোম, স্মার্ট সিটি ও শিল্প অটোমেশন—সবখানেই ছোট, শক্তি-সাশ্রয়ী সেমিকন্ডাক্টর প্রয়োজন।

৩. কোয়ান্টাম কম্পিউটিং

কোয়ান্টাম প্রসেসর তৈরিতেও বিশেষ ধরনের সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।

৪. বৈদ্যুতিক যানবাহন (EV)

বৈদ্যুতিক গাড়ি ও চার্জিং অবকাঠামোর জন্য পাওয়ার সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার বহুগুণে বাড়বে।

৫. অভ্যন্তরীণ গবেষণা ও নতুন উপাদান

সিলিকনের পাশাপাশি এখন গ্যালিয়াম নাইট্রাইড (GaN), সিলিকন কার্বাইড (SiC) ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে।

এগুলো আরও দ্রুত ও শক্তি-সাশ্রয়ী।

উপসংহার

সেমিকন্ডাক্টর শুধুমাত্র একটি পদার্থ নয়, এটি আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতির চালিকাশক্তি। আজকের স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা, মহাকাশ গবেষণা—সবকিছুই সেমিকন্ডাক্টরের উপর নির্ভরশীল। ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনের বিকাশে এর গুরুত্ব আরও বহুগুণে বাড়বে। তাই বিশ্ব অর্থনীতি ও প্রযুক্তির নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি দেশ এখন সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন ও গবেষণায় বিনিয়োগ করছে।

অতএব বলা যায়, সেমিকন্ডাক্টর হলো আধুনিক প্রযুক্তির হৃদস্পন্দন, যা ছাড়া ভবিষ্যতের কোনো উন্নত সমাজ কল্পনা করা যায় না।

banglablogs.in ©️ 2025
All rights reserved

Leave a comment